স্টাফ রিপোর্টারঃ
ইসলাম বিবাহকে এক পবিত্র ও সামাজিক বন্ধন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যখন পারস্পরিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না, তখন ধর্মীয় বিধানে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই বিচ্ছেদের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। কোরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—তালাক অনুমোদিত হলেও এটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ।
কোরআনের দৃষ্টিতে তালাকের নিয়ম, পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারা (২:২২৯) আয়াতে বলা হয়েছে—“তালাক দু’বার পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। এরপর হয় সুন্দরভাবে স্ত্রীকে রাখো অথবা সদয়ভাবে ছেড়ে দাও।”
অর্থাৎ, স্বামী সর্বোচ্চ দুইবার পর্যন্ত তালাক দিতে পারে, তৃতীয়বার তালাক দিলে সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ছিন্ন হয়ে যায়। প্রথম দুইবারের মধ্যে স্বামী চাইলে পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ (রুজু) করতে পারে।
একই সূরার ২:২২৮ আয়াতে বলা হয়েছে— “তালাকপ্রাপ্ত নারীরা তিনটি মাসিক পর্ব (তিন হায়েয) পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।”
এই অপেক্ষার সময়কে বলা হয় ইদ্দত, যার উদ্দেশ্য হলো গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করা এবং পুনর্মিলনের সুযোগ দেওয়া।
আর সূরা আত-তালাক (৬৫:১) আয়াতে নির্দেশ আছে—“যখন তোমরা নারীদের তালাক দাও, তখন তাদের ‘ইদ্দতের সময়’ অনুযায়ী তালাক দাও এবং ইদ্দত গণনা করো; আল্লাহকে ভয় করো।”
অর্থাৎ, তালাক দিতে হবে সংযম ও সচেতনতার সঙ্গে। মাসিক অবস্থায় বা সহবাসের পরপর তালাক দেওয়া শরীয়তসম্মত নয়।
হাদিসে তালাক সম্পর্কে সতর্কবাণী, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন— “হালাল জিনিসগুলোর মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত হলো তালাক।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২১৭৮)
অন্য এক হাদিসে তিনি বলেন— “তোমাদের কেউ যেন রাগের অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক না দেয়।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২০৪৬)
এছাড়া একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে বিদআত (নব উদ্ভাবিত ও অন্যায় কাজ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সহিহ মুসলিমে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী ﷺ ও আবু বকর (রা.)-এর যুগে একসাথে তিন তালাক দিলে তা এক তালাক হিসেবেই গণ্য হতো।
স্ত্রী কি নিজে থেকে তালাক দিতে পারে? ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গি ইসলামে শুধু পুরুষ নয়, নারীরও বৈধভাবে বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে। নারীর বিচ্ছেদের তিনটি পথ ইসলামি শরীয়তে স্বীকৃত — খুলা, ফাশখ ও তাওফীদ (delegated divorce)।
খুলা (Khulʿ): স্ত্রীর অনুরোধে বিচ্ছেদ, স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে বসবাসে অনাগ্রহী হয়, তাহলে সে মেহর বা কোনো ক্ষতিপূরণ ফেরত দিয়ে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইতে পারে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর যুগে জামো ইবনে কায়েসের স্ত্রী খুলা চাইলে নবী ﷺ তা অনুমোদন করেছিলেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৪৮৬৭)
ফাশখ (Faskh): বিচারিক বিচ্ছেদ, যদি স্বামী নির্যাতন করে, আর্থিক দায়িত্ব না নেয় বা অন্যায্য আচরণ করে, তবে স্ত্রী ইসলামী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। আদালত তদন্তের মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘোষণা করতে পারে।
তালাক-এ-তাওফীদ (Talaq al-Tafwid): ক্ষমতায়িত তালাক, বিবাহ চুক্তির সময় স্বামী যদি স্ত্রীর হাতে নির্দিষ্ট শর্তে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করে, তাহলে স্ত্রী নিজে সেই অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
ইসলামে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে প্রথমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সালিশ ও পুনর্মিলনের চেষ্টা করা বাধ্যতামূলক। (সূরা আন-নিসা ৪:৩৫)
পুনর্মিলন ব্যর্থ হলে স্বামী তালাক দিতে পারে, আর স্ত্রী খুলা বা ফাশখ চাইতে পারে।
তালাকের পর ইদ্দত পালন আবশ্যক; এ সময় উভয় পক্ষ চাইলে পুনর্মিলনের সুযোগ পায়।
তৃতীয় তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য হারাম হয়ে যায়, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কারো সঙ্গে বিবাহ করে এবং পরে বৈধভাবে বিচ্ছিন্ন হয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্লেষণ, ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, তালাক কোনো রাগের প্রতিক্রিয়া নয় বরং চিন্তাশীল ও ন্যায্য সিদ্ধান্তের অংশ। ইসলাম চায় না কোনো নারী অবিচারের শিকার হয়ে বন্ধনবদ্ধ থাকুক। তাই নারীকে খুলা ও বিচারিক বিচ্ছেদের পথ দিয়েছে।
স্থানীয় ইসলামি আইনজ্ঞদের মতে, “ইসলাম নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের জন্যই সমানভাবে বিচ্ছেদের পথ উন্মুক্ত রেখেছে, তবে তা যেন অপব্যবহৃত না হয়।”
ইসলাম দাম্পত্য সম্পর্কে শান্তি, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সম্মানকে অগ্রাধিকার দেয়। তালাককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র তখনই, যখন সম্পর্ক রক্ষা করা অসম্ভব হয়।
স্বামী যেমন তালাক দিতে পারে, তেমনি স্ত্রীও খুলা বা ফাশখের মাধ্যমে বিচ্ছেদ নিতে পারে— এটি ইসলামের ন্যায়বিচার ও সমতা নীতির প্রতিফলন।
তবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, তালাক বা বিচ্ছেদ যেন হয় সদয়তা, ন্যায় ও মর্যাদার সঙ্গে — অপমান বা প্রতিশোধের মাধ্যমে নয়।
কোরআন শরীফ (সূরা আল-বাকারা ২:২২৮–২২৯, সূরা আত-তালাক ৬৫:১, সূরা আন-নিসা ৪:৩৫, ৪:১৯) সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।
No comments